ডাঃ সিনহা আবুল মনসুর
ইতিহাসে উল্লেখ আছে,রোম যখন আগুনে পুড়ছিল, নিরো তখন তার প্রাসাদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বেহালা বাজাচ্ছিলেন! অগ্নিকানডটি ঘটেছিল ১৯ জুলাই, ৬৪ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দে। এটি ছিলো রোমের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ অগ্নিকাণ্ড। ছয়দিন ধরে আগুনের শিখা জ্বলতে থাকে। রোমের ১৪টি জেলার ১০টিই আগুনে পুড়ে যায়!
রোমবাসীর ধারণা এই অগ্নিকান্ড সম্রাট নিরো নিজেই ঘটিয়েছিলেন। কারণ, ধ্বংসস্তূপের জায়গায় তিনি তার অবিস্মরণীয় স্থাপত্যকর্ম ‘ডোমাস অরিয়া’ বা ‘স্বর্ণগৃহ’ নির্মান করতে চেয়েছিলেন। এই ধারণা আরো সত্য প্রতীয়মান হয় যখন দেখা যায় যে অগ্নিকান্ডের পর ধ্বংসস্তূপে নিরো তার স্থাপত্যকর্ম তৈরির জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। এর জন্য তার প্রচুর অর্থের দরকার হয়ে পড়েছিল। ফলে তিনি কর বাড়ান। মন্দিরগুলো থেকে অর্থ তুলতে শুরু করেন। অনেকের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে শুরু করেন।
কিন্তু নিরো নিজে এই অগ্নিকাণ্ডের পেছনে খৃষ্টানদের দায়ী করেন। কারণ তার শাসনামলের প্রথম দিকে তিনি খৃষ্টানদের খুব অত্যাচার করতেন । নিরোর ধারণা তারা প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে এই অগ্নিকাণ্ড ঘটাতে পারে।
কিন্তু প্রচলিত এসব গল্পের কিছু সমস্যা আছে। যেমন, প্রাচীন রোমে বেহালার অস্তিত্ব ছিল না। সংগীতের ইতিহাস নিয়ে যারা গবেষণা করেন তাদের দাবি ১১ শতাব্দীর আগে বেহালা আবিষ্কার হয়নি। যদি নিরো কিছু বাজিয়েই থাকেন সেটা হতে পারে ‘কিথারা’। কিথারা হচ্ছে ভারী কাঠের তৈরি চার থেকে সাত তন্ত্রের একটি সুরযন্ত্র।
রোমের ইতিহাসবিদ ট্যাসিটাস বলছেন: ‘অগ্নিকাণ্ডের সময় নিরো রোম থেকে ৩৫ মাইল দূরে এন্টিয়াম শহরে ছিলেন। আগুনের খবর শুনে তিনি দ্রুত রোমে ফিরে যান। ত্রাণকার্যক্রম শুরু উদ্যোগ নেন। নিজস্ব তহবিল থেকে এর যাবতীয় ব্যয়ভারও তিনি গ্রহণ করেন। এমনকি যে প্রাসাদে দাঁড়িয়ে তিনি বেহালা বাজাচ্ছিলেন বলে গুজব প্রচলিত, সেখানে তিনি বরং গৃহহীনদের আশ্রয় দেন। তাদের মধ্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেন’! ট্যাসিটাস একদমই নিরো সমর্থক ছিলেন না। তিনি বরং ব্যাক্তিগতভাবে নিরোর অন্যান্য অপকর্মের জন্যে ঘৃণা আর ধিক্কার পোষণ করতেন।
তাহলে নিরো সম্পর্কে কেনো এই গুজব ছড়ানো হয়েছিল? যা আবার এমনই এক গুজব যেটি পাঠ্যপুস্তকে পর্যন্ত প্রবাদ বাক্য হিশেবে বহুল প্রচলিত! বস্তুত, সম্রাট নিরো রোম পুড়ে যাওয়ার সময় বেহালা বাজাচ্ছিলেন এই কথাটি ছড়ানো শুরু হয় ওই অগ্নিকান্ডের দেড়শ বছর পর থেকে! আর এই কাহিনীটি রচনা করেছিলেন ক্যাসিও ডিও।
আর এই গুজবটি মানুষকে বিশ্বাস করতে শুরু করে নিরোর কারণেই। কারণ, অগ্নিকাণ্ডের পর নিরো সেখানে তার স্বপ্নের ‘ডোমাস অরিয়া’ বা ‘স্বর্ণগৃহ’ নির্মাণ শুরু করেন। ‘ডোমাস অরিয়া’ স্থাপত্যকলার এক অনন্য নিদর্শন!
কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, এই অনন্য নিদর্শনের কারণে মানুষ তাকে মনে রাখবে না। কারণ,অগ্নিকাণ্ডের দায়ভার খৃষ্টানদের উপর চাপিয়ে তাদের হত্যা করা এবং ধ্বংসস্তূপের উপরই এই প্রাসাদ নির্মাণ শুরু করার মাধ্যমে নিরো নিজেই নিজেকে ভিলেন হিশেবে প্রতিষ্ঠা করার সুযোগটি দিয়ে গিয়েছেন!এটিই হয়তো ‘Irony of fate’!অথবা ‘Poetic justice’!
লেখক: নিউইয়র্ক প্রবাসী।